আশির দশকে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) অধীনে কাস্টমস, এক্সাইজ ও ভ্যাট কমিশনারেটে তৃতীয় শ্রেণির পদে চাকরি শুরু করেন মো. জালাল উদ্দিন। অবসরকালে তার সর্বশেষ পদ ছিল কাস্টমস ইন্সপেক্টর (সিপাহি)। সরকারি তথ্য বলছে, একজন কাস্টমস সিপাহির মাসিক বেতন ৯ হাজার থেকে সর্বোচ্চ ২১ হাজার টাকার মধ্যে সীমাবদ্ধ। অথচ অনুসন্ধানে উঠে এসেছে, এই সীমিত আয়ের চাকরি করেই তিনি বর্তমানে অন্তত ৪০ কোটি টাকার সম্পদের মালিক—যা নিয়ে এলাকায় বিরুপ প্রশ্নের মুখোমুখি হয়েছেন।
একাধিক তথ্য বলছে, জালাল উদ্দিন বর্তমানে ঢাকার খিলক্ষেত নামাপাড়া (বাঁশতলা) এলাকার স্থায়ী বাসিন্দা। মন্তাজবাগ রোডের ক-২০০/গ/১ নম্বর ৬ তলা হালকা সবুজ রঙের ভবনের মালিক তিনি। পাশের ঘ/১ নম্বর ৬ তলা ভবনটিও তার বলে স্থানীয়রা নিশ্চিত করেছেন।
বিশ্বস্ত সূত্র বলছে, বড় ছেলে রাজীবকে বড়ুয়া এলাকায় ১১ তলা একটি ভবন করে দিয়েছেন তিনি।
এদিকে গাজীপুরে কাপাসিয়া উপজেলার বারিষাব ইউনিয়নের বর্জাপুর গ্রামের বাসিন্দা হলেও আশপাশের অন্তত ছয়টি গ্রামে প্রায় ৩৮ বিঘা জমি কেনার প্রমাণ পাওয়া গেছে। নথি ও স্থানীয়দের তথ্য অনুযায়ী বর্জাপুর, ভিটারটেক, কুশদী, চরদুর্লভ, জালারচর এবং নরসিংদীর মনোহরদী উপজেলার লেবুতলা ইউনিয়নেও তার ঢের জমির মালিকানা রয়েছে।
অনুসন্ধানে জানা যায়, চাকরির শুরুতে পৈতৃক সূত্রে জালাল উদ্দিনের জমির পরিমাণ ছিল মাত্র ৬ কাঠা। অথচ কয়েক দশকের ব্যবধানে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪০ বিঘারও বেশি।
স্থানীয় ভূমি অফিস ও বিক্রেতা সূত্রে পাওয়া তথ্যে দেখা গেছে, তিনি একের পর এক ব্যক্তি ও পরিবারের কাছ থেকে দেড় শতাধিক কাঠা জমি কিনেছেন বিভিন্ন সময়ে।
এ ছাড়া স্ত্রী, পুত্রবধূ ও মেয়ের নামে রয়েছে বিপুল পরিমাণ স্বর্ণালংকার ও নগদ অর্থ। দুই ছেলের নামে শেয়ারবাজারে অন্তত ৫ কোটি টাকার বিনিয়োগ রয়েছে বলে তথ্য মিলেছে। মেয়ের জামাইকে ব্যবসার জন্য কোটি টাকার মূলধন দেওয়ার তথ্যও অনুসন্ধানে উঠে এসেছে।
জালাল উদ্দিনের মেয়ে জেরিনের স্বামী আবদুল মোমেন বলেন, শ্বশুরের মেয়েকে বিয়ে করেছি বলে কি তার সম্পত্তির হিসাব আমাকে দিতে হবে? ঢাকায় তার বাড়ি আছে, এটা সবাই জানে। কিন্তু এত সম্পদের কথা আমি নিজেই জানি না। আমাকে এ বিষয়ে জড়াবেন না।
তবে সূত্র জানায়, গাজীপুর শহরে মোমেনের নামেও উল্লেখযোগ্য জমি ও ব্যবসায়িক বিনিয়োগ রয়েছে, যার বড় অংশ এসেছে শ্বশুরের অর্থায়নে—এমন অভিযোগ স্থানীয়দের।
বারিষাব ইউনিয়নের চেয়ারম্যান বলেন, জালাল উদ্দিনকে এলাকায় কাস্টমসের কর্মকর্তা হিসেবেই সবাই চিনত। ঢাকায় বাড়ি আছে জানতাম। কিন্তু এত বিপুল সম্পদের কথা শুনে সত্যিই বিস্মিত।
খিলক্ষেত নামাপাড়া এলাকার এক বাসিন্দা, নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, জালাল সাহেব আমাকে একসময় চাকরির লোভ দেখিয়েছিলেন, ঘুষ চেয়েছিলেন। আমি রাজি হইনি। এখন তিনি তিনটি বাড়ি থেকে মাসে দেড়-দুই লাখ টাকা ভাড়া তোলেন। ছেলেকে ১১ তলা ভবন করে দিয়েছেন।”
তিনি আরও বলেন, জালালের আরেক ভাই একই পদে চাকরি করেও ঘুষ না খাওয়ায় ভাড়া বাসায় জীবন পার করেছেন। অথচ জালাল কোটি কোটি টাকার মালিক—এটাই বড় বিতর্কের জন্ম দিয়েছে।
গত ১৩ জুলাই হোয়াটসঅ্যাপে কথা হলে জালাল উদ্দিন এসব অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, এই জমি-বাড়ি সব আমার। আরও ৬–৭ কানি জমি আছে। আমি ব্যবসা করেই এসব সম্পত্তি করেছি। ঘুষ বা দুর্নীতি করে কিছু করিনি। ছেলেরা বেকার ছিল, তাই শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করেছি।
তবে কী ধরনের ব্যবসা, কী পরিমাণ মূলধন এবং কোথা থেকে সেই ব্যবসার অর্থ এসেছে—এসব প্রশ্নের সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য দিতে পারেননি তিনি।
জালাল উদ্দিনের চাচা বুরুজ আলী গণমাধ্যম কে বলেন, জালালের কখনো বড় ধরনের কোনো ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ছিল না। তেমন জমিজমাও ছিল না। অবৈধভাবে টাকা আয় করা ছাড়া এত সম্পদের মালিক হওয়া সম্ভব নয়। আমিও ২৫ কাঠা জমি তার কাছে বিক্রি করেছি। আমরা ভাবতাম সে বড় কর্মকর্তা।
এ বক্তব্যের বিষয়ে আবার প্রশ্ন করা হলে জালাল উদ্দিন তার ব্যবসার পরিধি সম্পর্কে নির্দিষ্ট কোনো ব্যাখ্যা দিতে পারেননি।
দুর্নীতি ও অর্থপাচার বিষয়ে কাজ করা এক অর্থনীতিবিদ বলেন, সরকারি চাকরিজীবীর ক্ষেত্রে আয়ের তুলনায় যদি সম্পদের পরিমাণ কয়েক গুণ বেড়ে যায়, সেটি আন্তর্জাতিকভাবেও ‘রেড ফ্ল্যাগ’ হিসেবে বিবেচিত হয়। এমন পরিস্থিতিতে সম্পদ বিবরণী, ব্যাংক লেনদেন, শেয়ারবাজার বিনিয়োগ—সবই ফরেনসিক অডিটের আওতায় আনা প্রয়োজন।
আইনবিদদের মতে, দুর্নীতি দমন কমিশন আইন অনুযায়ী আয়ের সঙ্গে অসংগতিপূর্ণ সম্পদ, পরোক্ষভাবে পরিবার-পরিজনের নামে অবৈধ সম্পদ অর্জন, এবং ঘুষের মাধ্যমে সম্পদ সঞ্চয়ের অভিযোগ তদন্তযোগ্য অপরাধ।
কাস্টমস সিপাহির সর্বোচ্চ বেতন (২১ হাজার টাকা) ধরেও ২০ বছরের চাকরিজীবনে আনুমানিক মোট আয় হয় প্রায় ৫০–৫৫ লাখ টাকা। সেখানে জালাল উদ্দিনের নামে থাকা জমি, ভবন, শেয়ারবাজার বিনিয়োগ ও নগদ অর্থের সম্মিলিত মূল্য কয়েক’শ কোটি টাকা—এই ব্যবধানই আলোচনার কেন্দ্র বিন্দুতে পরিণত করছে।
প্রশ্ন উঠছে : সীমিত বেতনের সরকারি চাকরি করে *কীভাবে ৪০ কোটির বেশি সম্পদ গড়ে উঠল?
*কথিত ব্যবসার বৈধ উৎস ও কর পরিশোধের প্রমাণ কোথায়?
*পরিবারের সদস্যদের নামে থাকা সম্পদের প্রকৃত মালিকানা ও অর্থের উৎস কী?
*সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ কি এই সম্পদের বিষয়ে কোনো অনুসন্ধান চালাচ্ছে?
তথ্য বলছে, মো. জালাল উদ্দিনের সম্পদের পরিমাণ তার সরকারি আয়ের তুলনায় অস্বাভাবিকভাবে বেশি। যদিও তিনি নিজে দুর্নীতি অস্বীকার করে ব্যবসার মাধ্যমে সম্পদ অর্জনের দাবি করেছেন, তবে সেই দাবির পক্ষে এখনো বিশ্বাসযোগ্য আর্থিক নথি ও কর পরিশোধের রেকর্ড প্রকাশ্যে আসেনি।
ফলে জনস্বার্থের প্রশ্ন হিসেবে এই সম্পদের উৎস নিয়ে স্বতন্ত্র ও নিরপেক্ষ তদন্ত এখন সময়ের দাবি—এমনটাই মত দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
