মোঃ লিঙ্কন : বাংলাদেশে ভবন নির্মাণ অবকাঠামো নকশা, ডিজাইন, এবং শহরের বহুতল স্থাপনা শৃঙ্খলায় ফেরানোর একটি রাষ্ট্রীয় স্বায়ত্ত্বশাসিত প্রতিষ্ঠান। সাম্প্রতিক সময়ে কিছু অসাধু কর্মকর্তা কর্মচারীদের দুর্নীতির কারণে দিন দিন নাভিশ্বাস উঠেছে।এই মূহুর্তে প্রশাসনিক ব্যবস্থার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক)এর অসাধু কর্মকর্তাদের লাগাম টেনে ধরতে যথাযথ উদ্যোগ গ্রহণ করা উচিৎ। রাজধানী ঢাকার নগর পরিকল্পনা, উন্নয়ন ও নির্মাণ কার্যক্রমের ওপর এ সংস্থার কর্তৃত্ব বিতর্কিত হচ্ছে। কিন্তু এই প্রতিষ্ঠানের ভেতরে দীর্ঘদিন ধরেই ঘাপটি মেরে থাকা দুর্নীতি, ঘুষ বাণিজ্য এবং অবৈধ অর্থ লেনদেনের অভিযোগ বিভিন্ন নিউজ পোর্টালে প্রকাশিত হয়েছে। তবুও থেমে নেই অপকর্ম। সাম্প্রতিক সময়ে সবচেয়ে বেশি আলোচিত হয়ে উঠেছে রাজউক এর বিতর্কিত পরিচালক মো. হামিদুল ইসলাম এর নাম। অভিযোগ রয়েছে, তিনি দায়িত্ব পালনের আড়ালে ঘুষ বাণিজ্যের এক বিশাল সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছেন এবং সরকারি চাকুরির সুযোগকে ব্যবহার করেছেন অবৈধ সম্পদ অর্জনের হাতিয়ার হিসেবে।
এই প্রতিবেদনটিতে রাজউক পরিচালক হামিদুল ইসলামের ঘুষ বাণিজ্য, অবৈধ সম্পদ ও তাঁর বিরুদ্ধে ওঠা নানা অভিযোগের বিশদ দুর্নীতির আদ্যোপান্ত তুলে ধরা হলো।
হামিদুল ইসলামের কর্মজীবন ও প্রভাব বিস্তার : তিনি দীর্ঘদিন ধরে সরকারি চাকুরির আড়ালে অবৈধ কাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত। চাকুরীর শুরুতে বিসিএস ক্যাডারে উন্নীত হয়ে রংপুর বিভাগ থেকে কর্মজীবন শুরু করলেও পরে তিনি রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) এর পরিচালক পদে যোগ দেন। সরকারি চাকরিতে পদোন্নতি ও বদলি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে তিনি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে ছিলেন এবং সেই দায়িত্ব পালনের সময়ই নানা অনিয়মের অভিযোগ ওঠে।
অভিযোগ রয়েছে, তিনি প্রভাব খাটিয়ে প্রকল্প অনুমোদন, নকশা পাস, জমি বরাদ্দ ও আবাসন প্রকল্পের অনুমতি দেওয়ার নামে কোটি কোটি টাকা ঘুষ নিয়েছেন। তাঁর এই প্রভাবের কারণে অনেক অবৈধ ভবন বৈধতা পেয়েছে, যেগুলোর কারণে রাজধানীর অবকাঠামো ও নগরায়ণ আজ ভয়াবহ নানা সমস্যায় জর্জরিত।
হামিদুল ইসলামের বিরুদ্ধে পাওয়া অভিযোগের মধ্যে সবচেয়ে সমালোচিত হচ্ছে অভিনভ ঘুষ বাণিজ্যের অপকৌশল।
রাজধানীতে একটি বহুতল ভবন নির্মাণ করতে হলে রাজউকের অনুমোদন জরুরি। এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে হামিদুল ইসলাম নকশা অনুমোদনের নামে বিপুল অঙ্কের ঘুষ নিতেন। অনেক ক্ষেত্রেই অবৈধভাবে নির্মিত ভবনকে ঘুষের বিনিময়ে বৈধতা দিতেন।হামিদুলের ফ্ল্যাট ও বাড়ি : ঢাকার একাধিক অভিজাত এলাকায় তাঁর এবং পরিবারের সদস্যদের নামে রয়েছে একাধিক ফ্ল্যাট ,ও প্লট।
অবৈধ উপায়ে নিজ গ্রামে অর্জিত সম্পদ: নিজ গ্রামের বাড়িতেও বিলাসবহুল ভবন ও জমি কেনা হয়েছে, যা সাধারণ একজন সরকারি কর্মকর্তার আয়ের সঙ্গে অসঙ্গতিপূর্ণ।
বিলাসবহুল গাড়ি : ব্যক্তিগত ব্যবহারের জন্য একাধিক গাড়ি রয়েছে, যা তাঁর সরকারি আয়ের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।
অর্থ লেনদেন: বিভিন্ন সময়ে প্রভাবশালী ব্যক্তিদের সঙ্গে আর্থিক লেনদেনের বিষয়েও প্রমাণ পাওয়া গেছে।
একাধিক ভুক্তভোগীদের দাবি, তিনি গত এক দশকে অবৈধভাবে কয়েকশ কোটি টাকার সম্পদ গড়েছেন যা সাধারণের নজর কাড়ে।
রাজউক সাধারণত নগরবাসীর উন্নয়ন পরিকল্পনা বাস্তবায়নের প্রতিষ্ঠান হলেও এর ভেতরের দুর্নীতির কারণে মানুষ ভোগান্তির শিকার হয়ে আসছেন।
সাধারণ মানুষ মনে করে, রাজউক কর্মকর্তাদের ঘুষ ছাড়া কোনো কাজ হয় না।
ভবন মালিকরা বলেন, “নকশা পাশ করতে গেলে অফিসিয়ালি সরকারি ফি, তার চেয়ে দশগুণ বেশি টাকা গুনতে হয়।”
নাগরিক সমাজ মনে করছে, এই দুর্নীতি থামানো না গেলে রাজধানী ঢাকার উন্নয়ন চরম হুমকির মুখে পড়বে এবং সরকারের আস্থাশীল এ প্রতিষ্ঠানটির ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হবে।
নগর পরিকল্পনাবিদদের মতে, রাজউকের কর্মকর্তারা যদি দায়িত্বশীলভাবে কাজ করতেন, তাহলে রাজধানী ঢাকা শহরে নগরবাসী কে একটি সুন্দর ও সুশৃঙ্খল শহর উপহার দিতে পারতেন। কিন্তু ঘুষ ও দুর্নীতির কারণে শহরটি নানামুখী সমালোচনার জন্ম দিয়েছেন অসাধু কর্মকর্তারা।
একজন বিশেষজ্ঞ বলেন- “রাজউকের মধ্যে যেসব দুর্নীতি চলছে, তা যদি বন্ধ করা যেত, তাহলে শহর উন্নয়নে ব্যয় কমপক্ষে ৩০% কমে আসত। কিন্তু কর্মকর্তাদের ব্যক্তিগত স্বার্থের কারণে সাধারণ মানুষকে কষ্ট পোহাতে হচ্ছে।
দৈনিক স্বাধীন কাগজ এর প্রতিবেদক মোঃ লিঙ্কন বলেন, আমাদের অনুসন্ধান অব্যাহত থাকছে পরবর্তী সংখ্যায়।দুদক সূত্রে জানা গেছে, ইতোমধ্যে হামিদুল ইসলামের বিরুদ্ধে একাধিক অভিযোগ জমা পড়েছে। গত বছরের অগাস্টে তাঁর বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ আনুষ্ঠানিক তদন্ত শুরু হয়েছে। অভিযোগের মধ্যে রয়েছে ঘুষ, অবৈধ সম্পদ অর্জন,ও ক্ষমতার অপব্যবহার করে নামে-বেনামে অঢেল সম্পদ অর্জন। দুদক আরও জানিয়েছে, তাঁর সম্পদ বিবরণী তলব করা হয়েছে এবং তদন্ত শেষে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
অভিযোগগুলো সম্পর্কে হামিদুল ইসলাম দাবি করেন,তিনি নির্দোষ এবং সবকিছু রাজনৈতিকভাবে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত।
সম্পদের অনেকটাই নাকি তাঁর পারিবারিক উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া। ঘুষ বা দুর্নীতির অভিযোগ প্রমাণিত হয়নি। তবে সংশ্লিষ্ট মহল মনে করছে, তাঁর দাবি বাস্তবতার সঙ্গে মিলনেই এবং প্রমাণাদি অনেকাংশেই তাঁর বিরুদ্ধে। হামিদুল ইসলামের মতো প্রভাবশালী কর্মকর্তাদের দুর্নীতি শুধু ব্যক্তিগত লোভের কারণে নয়, বরং গোটা ব্যবস্থার দুর্বলতার কারণেও হচ্ছে।
ফলে একজন সরকারি কর্মকর্তা চাকরির আড়ালে কোটি কোটি টাকার মালিক বনে যাচ্ছেন, অথচ সাধারণ মানুষ ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।
রাজউক পরিচালক হামিদুল ইসলামের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ কেবল একজন ব্যক্তির নয়, বরং গোটা ব্যবস্থার দুর্বলতার প্রতিচ্ছবি। নগর পরিকল্পনার মতো গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রতিষ্ঠানে যদি দুর্নীতি এতটা প্রভাব বিস্তার করে, তবে দেশের উন্নয়ন ও জনগণের ভবিষ্যৎ মারাত্মকভাবে হুমকির মুখে পড়বে।
দুদক ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের এখনই উচিত সঠিক তদন্ত করা, প্রমাণ অনুযায়ী কঠোর শাস্তি নিশ্চিত করা এবং রাজউকের ভেতরে সিন্ডিকেট ভেঙে ফেলা। অন্যথায় এ দুর্নীতির শেকড় আরো গভীরে প্রবেশ করলে একসময় গোটা রাষ্ট্রীয় উন্নয়নকে প্রশ্নবিদ্ধ করবে অন্যদিকে সরকারের ভাবমূর্তি ইমেজ সংকটে ফেলবে।
এসব অনিয়মের বিষয় জানতে চেয়ে রাজউক পরিচালক হামিদুল ইসলাম এর মুঠোফোনে একাধিকবার কল দেওয়া হলেও তিনি ফোনকল গ্রহণ করেননি।