১০ মাসে দেশে ৩৩০০ খুন; মবে ১৬৫ ও রাজনৈতিক সহিংসতায় ঝরেছে ৯০ প্রাণ * আক্রান্ত ৫৩১ পুলিশ সদস্য।
রাজধানীসহ দেশজুড়ে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি এখন স্পষ্ট। বড় শহর থেকে উপজেলা পর্যায়ে-সবখানেই বাড়ছে সহিংসতা, খুন ও চাঁদাবাজি। সক্রিয় ‘মব গ্রুপ’। গেল ১০ মাসে দেশে ৩৩০০ খুনের ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে রাজনৈতিক সহিংসতায় ঝরেছে ৯০টি প্রাণ। আক্রান্ত হয়েছেন পাঁচ শতাধিক পুলিশ সদস্য। এ অবস্থায় ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে জনমনে উদ্বেগ বাড়ছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, নির্বাচনের আগে আইন হাতে তুলে নেওয়ার প্রবণতা (মব) এবং অপরাধীচক্রের তৎপরতা নিয়ন্ত্রণ এখন সরকারের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। তারা মনে করছেন, অপরাধ দমনে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ভঙ্গুর অবস্থাও কাটেনি। মাঠপর্যায়ের অনেক সদস্যের মনোবল আক্রান্ত। এ কারণে ছোটখাটো বিরোধ থেকে শুরু করে আধিপত্য বিস্তার-সবই গড়াচ্ছে হত্যাকাণ্ডে। তাছাড়া লুট হওয়া অস্ত্র নিরাপত্তাঝুঁকি তৈরি করতে পারে।
এদিকে নির্বাচনের আগে ও পরে দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে দেড় লাখ পুলিশ সদস্যকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। তবে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি নিয়ে ক্ষোভ ও হতাশা প্রকাশ করেছেন খোদ পুলিশপ্রধান।
পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজি) বাহারুল আলম যুগান্তরকে বলেন, আমরা আমাদের কাজ করে যাচ্ছি। নিয়ন্ত্রণ করার মতো কোনো ম্যাজিক নেই পুলিশের হাতে। সম্প্রতি ধানমন্ডিতে পুলিশের সঙ্গে যে ব্যবহার করা হয়েছে, এগুলোর পেছনে কী উদ্দেশ্য জানি না। তারা তো অধিকাংশই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কর্মী। তারা পুলিশের সঙ্গে যেভাবে ছাত্রলীগের মতো আচরণ করেছে, তাতে আমরা চেষ্টা, প্রচেষ্টা যা-ই করছি না কেন, সবই মনে হচ্ছে বিফল হয়ে যাবে। তিনি বলেন, পুলিশ কার্যকর হোক-এটা চায় কি না, তা সমাজকেই ঠিক করতে হবে। ‘ফ্লাইং কিক’ মারবে পুলিশকে কীসের জন্য? এতে প্রতীয়মান হয় পুলিশ ফেল, এভাবে পুলিশের মনোবল ভেঙে দেওয়া হচ্ছে।
আইজিপি বলেন, আমি খুবই হতাশ এই আচরণে। সমাজের কোনো একটা জায়গা থেকে কেউ বলল না পুলিশের সঙ্গে এই কাজটা ঠিক হয়নি। পুলিশের সঙ্গে আপনি ছাত্রলীগের মতো ব্যবহার করছেন কেন? এরকম আচরণ করলে পুলিশের পক্ষে আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব হবে না।
জানা যায়, দেশে মববেটিং বা গণপিটুনি এখনো নিয়ন্ত্রণের বাইরে। ট্যাগ, গুজব, সন্দেহ, চুরির অভিযোগ বা সামান্য তর্ক-যে কোনো কারণেই দলবদ্ধ হয়ে মানুষ হামলে পড়ছে মানুষের ওপর। এছাড়া সাম্প্রতিক সময়ে বেশকিছু হত্যাকাণ্ড এবং আন্ডারওয়ার্ল্ডের উত্তাপ উদ্বেগ বাড়িয়েছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে দুর্বল মনে করছে অপরাধীরা, যার সুযোগ নিচ্ছে সংঘবদ্ধ চক্রগুলো।
বুধবার রাতে পল্লবী থানার সামনে দুর্বৃত্তদের ছোড়া ককটেলে এক পুলিশ সদস্য আহত হয়েছেন। এছাড়া সোমবার সন্ধ্যায় পল্লবী এলাকায় যুবদল নেতা গোলাম কিবরিয়াকে গুলি করে হত্যা করা হয়। এর আগে ১০ নভেম্বর ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতের মূল গেটের বিপরীতে ন্যাশনাল মেডিকেলের সামনে গুলি করে হত্যা করা হয় শীর্ষ সন্ত্রাসী তারিক সাইফ মামুনকে। আন্ডারওয়ার্ল্ডের আধিপত্যকে কেন্দ্র করেই এ হত্যাকাণ্ড ঘটে। এছাড়া ১৭ নভেম্বর ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে শেখ মুজিবুর রহমানের বাড়িটি একেবারে গুঁড়িয়ে দিতে দুটি এক্সকেভেটর নিয়ে ছাত্র-জনতার সমর্থকরা জড়ো হন। এ সময় পুলিশের সঙ্গে পালটাপালটি ধাওয়ার ঘটনা ঘটে। পুলিশ সদস্যের ওপর হামলার একাধিক ভিডিও ছড়িয়ে পড়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। শুধু এসব ঘটনাই নয়, দেশের বিভিন্ন স্থানে মবসহ নানা অপরাধের ঘটনা ঘটেই চলছে।
পুলিশ সদর দপ্তরের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ১০ মাসে দেশের ৩ হাজার ৩৩০টি খুনের মামলা হয়েছে। এই সময়ে পুলিশ সদস্য আহত হয়েছেন ৫৩১ জন। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ডিএমপিতে একই সময়ে হত্যা মামলা রেকর্ড হয়েছে ৩৭১টি। আর পুলিশ সদস্য আহতের ঘটনা ঘটেছে ৮৫টি। এদিকে আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) পরিসংখ্যান বলছে, চলতি বছরের ১০ মাসে দেশে মবের শিকার হয়ে প্রাণ হারিয়েছেন ১৬৫ জন। এর মধ্যে ঢাকা বিভাগে ৭২, খুলনায় ১৭, রাজশাহীতে ১৩, রংপুরে ৭, সিলেটে ৪, চট্টগ্রামে ২৮, বরিশালে ১৪ ও ময়মনসিংহে ১০ জন। একই সময়ে দেশে রাজনৈতিক সহিংসতার ৩৫১টি ঘটনায় ৯০ জনের প্রাণহানি ঘটেছে। আহত হয়েছেন ৩ হাজার ৮৩৫ জন।
বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে হলে মব ভায়োলেন্স থেকে সরে আসতে হবে। গণতন্ত্রের প্রধানতম কথা হচ্ছে আপনাকে অন্যের মত সহ্য করতে হবে। আমি তোমার সঙ্গে একমত না হতে পারি; কিন্তু তোমার মতপ্রকাশের যে স্বাধীনতা, তা আমি আমার জীবন দিয়ে হলেও রক্ষা করব। দ্যাট ইজ ডেমোক্রেসি।
পুলিশের সাবেক আইজি মোহাম্মদ নূরুল হুদা বলেন, পুলিশকে দ্রুত মনোবল ফিরিয়ে আনা, এলাকায় এলাকায় চিহ্নিত অপরাধীচক্র দমন, ওয়ারেন্টভুক্ত ও জামিনে থাকা ঝুঁকিপূর্ণ ব্যক্তিদের নজরদারি আরও বাড়াতে হবে। না হলে নির্বাচনের আগে সহিংসতা আরও বাড়তে পারে।
মানবাধিকারকর্মী নূর খান লিটন বলেন, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে না পারলে দেশে মবের মতো ঘটনা ঘটতেই থাকবে। সরকার মুখে শক্ত কথা বললেও কার্যত এমন কোনো ব্যবস্থা নিতে পারেনি, যে মানুষ ভয় পাবে। ফলে সরকারকে কার্যকর ব্যবস্থা নিয়ে দেখাতে হবে যে তারা এ ব্যাপারে মুখে নয়, কাজে শক্ত।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ড. তৌহিদুল হক যুগান্তরকে বলেন, মব নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতা আইনশৃঙ্খলার গভীর সংকটকে সামনে নিয়ে আসছে। মানুষ যদি বিশ্বাস হারিয়ে ফেলে যে রাষ্ট্র তাকে নিরাপত্তা দেবে, তখন ‘নিজেদের হাতে বিচার তুলে নেওয়ার’ প্রবণতা বাড়ে। এতে সমাজ আরও অস্থিতিশীল হয়ে পড়ে।
মওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমিওনোলজি ও পুলিশ সায়েন্স বিভাগের অধ্যাপক ড. ওমর ফারুক যুগান্তরকে বলেন, মব ভায়োলেন্স হলো রাজনীতির একটি অপসংস্কৃতি। মবের পেছনে নানা হীন স্বার্থ থাকে। মব ভায়োলেন্স বন্ধে সরকার উদ্বোগ নিয়েছে, তবে পরিপূর্ণভাবে মব নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনি। মবের সঙ্গে যারা জড়িত, তারা রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় রয়েছে। তাই রাজনৈতিকভাবে সবাইকে মব বন্ধে একটা কমিটমেন্টের জায়গায় আসতে হবে।
পুলিশ সদর দপ্তরের এআইজি (মিডিয়া) এএইচএম শাহাদাত হোসাইন বলেন, নির্বাচন সামনে রেখে দেড় লাখ পুলিশ সদস্যকে ট্রেনিং দেওয়া হচ্ছে। তাদেরকে নির্বাচনের সময়, এর আগে ও পরে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি মোকাবিলায় কাজে লাগানো হবে। শুধু তাই নয়, নির্বাচন সামনে রেখে অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারেও অভিযান পরিচালনা হচ্ছে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে যাবতীয় পদক্ষেপ নেওয়া হবে। কার্যক্রম নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগের ষড়যন্ত্র ও মব তৈরির বিষয়েও সতর্ক পুলিশ।
