শুক্রবার, ২৮শে নভেম্বর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ | ১৩ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
আজকের সর্বশেষ সবখবর

দেশের ধন্যাঢ্য ব্যক্তিরাও প্রতারণার শিকার অনিক ও সোহেলের ভুয়া “প্রাচীন পিলার ও কয়েন” চক্র

নিজস্ব প্রতিবেদক
নভেম্বর ২৭, ২০২৫ ২:৫৪ অপরাহ্ণ
Link Copied!

দেশে এক অভিনব প্রতারণার চক্রের উন্মোচন ঘটেছে, যা সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে দেশের ধন্যাঢ্য ব্যবসায়ী, শিল্পপতি এবং উচ্চপদস্থ ব্যক্তিদের পর্যন্ত নিঃস্ব করে ফেলেছে। এই চক্রের মূল হোতারা হলেন অনিক ও সোহেল। তাদের প্রতারণা কৌশল ভুয়া “প্রাচীন পিলার” ও কয়েনের মাধ্যমে পরিচালিত হয়, যা অত্যন্ত সুচিন্তিত, অভিনব এবং জটিল। প্রাথমিক তদন্ত ও ভুক্তভোগীদের বর্ণনার ভিত্তিতে দেখা গেছে, প্রতারণার কৌশল এতটাই সূক্ষ্ম এবং পেশাদার ছিল যে কেউ সন্দেহ করতে পারেননি। এই প্রতিবেদনে আমরা বিস্তারিতভাবে তুলে ধরছি কিভাবে প্রতারণা হয়েছে, কারা শিকার হয়েছে, কৌশল কেমন ছিল এবং কী ধরনের প্রমাণ রয়েছে।

প্রতারণার কৌশল : ভুক্তভোগীদের সাক্ষাৎকার এবং অনুসন্ধান অনুযায়ী, অনিক ও সোহেলের প্রতারণা কৌশলকে কয়েকটি ধাপে ভাগ করা যায়:

১. প্রাচীন ও বিরল বস্তু হিসেবে উপস্থাপন : প্রতারকেরা সাধারণ কয়েন, পাথর বা সিলিন্ডার আকৃতির বস্তুকে প্রাচীন বলে দাবি করতেন। কৃত্রিমভাবে বয়স দেখানোর জন্য তারা প্যাটিনা, দাগ এবং বিভিন্ন চিহ্ন তৈরি করতেন। বস্তুগুলোকে ইতিহাসভিত্তিক ব্যাখ্যা দিয়ে “বিশেষ বিনিয়োগ” হিসাবে উপস্থাপন করা হত। রূপা (ছদ্মনাম), একজন ভুক্তভোগী বলেন, “ওরা বলেছিল পিলারটি প্রাচীন মন্দিরের অংশ। আমরা ছবি এবং ইতিহাস দেখে বিশ্বাস করেছিলাম। পরে বুঝলাম এটি কৃত্রিম। আমাদের অর্থের সবটাই হারালাম।” ফরহাদ, আরেক ভুক্তভোগী, জানান, “কয়েনগুলো ‘রেয়ার’ বলেই চাপ দেওয়া হয়েছিল। আমরা লেনদেন করেছি—পরবর্তীতে মেটাল টেস্টে বোঝা গেল সব ভুয়া।”

ফাইভস্টার হোটেলের বিলাসবহুল পরিবেশে অপারেশন : প্রতারকেরা ফাইভস্টার হোটেলের লাউঞ্জ, কনফারেন্স রুম এবং রেস্টুরেন্টে প্রদর্শনী ও ব্যক্তিগত ডিলের আয়োজন করতেন। বিলাসবহুল পরিবেশ ভুক্তভোগীদের মনে আস্থা তৈরি করত। হোটেলের পরিবেশ, সজ্জা এবং প্রফেশনাল আচরণ দেখেই ক্রেতারা বড় অঙ্কের লেনদেনে ঝুঁকতেন। ভুক্তভোগীরা বলেন, “হোটেলের বিলাসবহুল লাউঞ্জে বসে তারা এত পেশাদারীভাবে প্রেজেন্টেশন করেছিল যে কেউ সন্দেহ করতে পারেনি। আমরা বিশ্বাস করেছিলাম এটি নিরাপদ বিনিয়োগ।”

ধন্যাঢ্য ব্যক্তিদের টার্গেট করা : চক্রের একটি প্রধান কৌশল ছিল দেশের ধন্যাঢ্য ও উচ্চপদস্থ ব্যক্তিদের টার্গেট করা। তারা নিজেদেরকে প্রফেশনাল, অভিজ্ঞ এবং ইতিহাস বিশেষজ্ঞ হিসেবে উপস্থাপন করতেন। বড় ব্যবসায়ী, শিল্পপতি এবং উচ্চশিক্ষিত ব্যক্তিরা তাদের টার্গেট হয়েছিলেন। ভুক্তভোগী অনেকে জানান, তারা এই বিলাসবহুল পরিবেশে এবং পেশাদারী প্রেজেন্টেশন দেখে ভুল করে বড় অঙ্কের অর্থ প্রদান করেছিলেন।

বৃহৎ আর্থিক লেনদেন : প্রতারকেরা এই প্রক্রিয়ায় শত শত মানুষকে বড় অঙ্কের অর্থ প্রদান করিয়েছেন। প্রাথমিক অভিযোগ অনুযায়ী, দেশের শতাধিক ব্যক্তি এই চক্রের শিকার হয়েছেন। সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে ধন্যাঢ্য ব্যক্তি—সবারই অর্থ ক্ষতি হয়েছে।

কৌশলগত অদৃশ্যতা : লেনদেনের পর তারা কখনও উপস্থিত থাকতেন না, আবার কখনও অর্ধেক বস্তু বা কৃত্রিম কাগজপত্র দেখিয়ে অর্থ আত্মসাৎ করতেন। এই কৌশল ভুক্তভোগীদের হতবিহ্বল করত এবং তদন্ত শুরু করার আগে তারা অনেক দূর চলে যেত।

চক্রের বিস্তারের মাত্রা বিশাল। প্রাথমিকভাবে জানা যায় সাধারণ মানুষ ৫০-৭০ জন। বৃহৎ ব্যবসায়ী ও শিল্পপতি ২০-৩০ জন। উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তা ও প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তি ১০-২০ জন।

ভুক্তভোগীরা বিভিন্ন শহর থেকে এসেছে ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেট, খুলনা এবং রাজশাহী। প্রায় সকল ভুক্তভোগী একই পদ্ধতিতে অর্থ হারিয়েছেন: ফাইভস্টার হোটেলে প্রদর্শনী দেখার পর বড় অঙ্কের লেনদেন।

প্রাথমিক অনুসন্ধান অনুযায়ী চক্রটি কয়েকটি ধাপে পরিচালিত হয়েছে:

বিশ্বাস তৈরি : ফাইভস্টার হোটেলের বিলাসবহুল পরিবেশে প্রদর্শনী।

প্রচারণা ও বিক্রয় : সম্ভাব্য ক্রেতাদের সঙ্গে সরাসরি বা অনলাইনে যোগাযোগ।

লেনদেন ও অদৃশ্যতা : অর্থ গ্রহণের পর উপস্থিত না থাকা বা ভুয়া কাগজপত্র প্রদর্শন।

প্রভাব বিস্তার : বড় অঙ্কের অর্থ আত্মসাৎ এবং দেশের ধন্যাঢ্য ব্যক্তিদেরও শিকার বানানো।

ভুক্তভোগীরা বিভিন্ন ধরনের প্রমাণ সংগ্রহ করেছেন: লেনদেনের রশিদ ও ব্যাংক ট্রান্সফার। ফেসবুক/মেসেঞ্জারে কথোপকথনের স্ক্রিনশট। প্রদর্শিত বস্তু বা নমুনা। প্রত্যক্ষদর্শী ও হোটেলকর্মীদের বিবৃতি।

ফরেনসিক বিশেষজ্ঞদের মতে, এই বস্তুগুলো পরীক্ষা করার জন্য মেটাল কমপজিশন টেস্ট, স্ট্রাকচারাল বিশ্লেষণ এবং প্যাটিনা পরীক্ষা অপরিহার্য।

প্রফেশনাল বিশেষজ্ঞরা বলেন, “প্রাচীন বস্তু যাচাই করার জন্য শুধুমাত্র চেহারা বা ইতিহাসভিত্তিক ব্যাখ্যা যথেষ্ট নয়। ল্যাবরেটরি টেস্ট এবং প্রমাণভিত্তিক যাচাই প্রয়োজন।”

আইনগত দিক থেকে, প্রতারণা, জাল বিক্রয় এবং প্রতারণামূলক ব্যবসায়িক কৌশল এই চক্রের অন্তর্ভুক্ত। ভুক্তভোগীরা থানায় ঋওজ দায়ের করে এবং প্রমাণাদি জমা দিয়ে মামলা করতে পারেন।

দেশের শতাধিক মানুষ অর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত। সাধারণ মানুষের আস্থা ও বিশ্বাস নষ্ট হয়েছে। ভবিষ্যতে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে সতর্কতার প্রয়োজনীয়তা বৃদ্ধি পেয়েছে।

অনিক ও সোহেলের প্রতারণা কেবল আর্থিক ক্ষতি নয়, দেশের ধন্যাঢ্য এবং সাধারণ মানুষের আস্থা নষ্ট করেছে। প্রমাণভিত্তিক তদন্ত এবং আইনগত পদক্ষেপ গ্রহণ না হলে এই ধরনের চক্র আরও বিস্তার লাভ করতে পারে। ভুক্তভোগীরা একত্রিত হয়ে মামলা করলে, প্রমাণাদি ও ফরেনসিক বিশ্লেষণের মাধ্যমে চক্রটি ভেঙে ফেলা সম্ভব। সামাজিক সচেতনতা এবং পেশাদারী যাচাই ছাড়া বিনিয়োগ থেকে বিরত থাকা দেশের জনগণের জন্য গুরুত্বপূর্ণ সতর্কবার্তা।

এই সাইটে নিজম্ব নিউজ তৈরির পাশাপাশি বিভিন্ন নিউজ সাইট থেকে খবর সংগ্রহ করে সংশ্লিষ্ট সূত্রসহ প্রকাশ করে থাকি। তাই কোন খবর নিয়ে আপত্তি বা অভিযোগ থাকলে সংশ্লিষ্ট নিউজ সাইটের কর্তৃপক্ষের সাথে যোগাযোগ করার অনুরোধ রইলো।বিনা অনুমতিতে এই সাইটের সংবাদ, আলোকচিত্র অডিও ও ভিডিও ব্যবহার করা বেআইনি।
বিশেষ খবর সর্বশেষ