যশোরে প্রায় ৩০ বছর কসাইখানা বা আধুনিক স্লটার হাউজ না থাকলেও পৌরসভাকে নিয়মিত ‘কর’ দিচ্ছেন মাংস বিক্রেতারা। বিনিময়ে তারা পাচ্ছেন ভোক্তা ঠকানোর লাইসেন্স। তাই তাদের নগরীতে পশু জবাই ও মাংস বিক্রির জন্য কোনো নিয়মকানুন মানতে হয় না। ফলে মাংসের নামে কী খাচ্ছেন-প্রশ্নটি পৌর নাগরিকদের।সম্প্রতি শহরতলির ধর্মতলায় এক মাংস ব্যবসায়ী বাছুরসহ গাভি জবাইয়ের ঘটনা ঘটে। এঁড়ে গরুর মাংস বলে তিনি গর্ভবতী গাভির মাংস বিক্রি করছিলেন। খবর পেয়ে টাস্কফোর্স সেখানে অভিযান চালায়। মালিক পালিয়ে গেলেও ভ্রাম্যমাণ আদালত তাকে জরিমানা করেন। এর আগে ২০২৩ সালের মার্চে শহরের বড়বাজারের কাঠেরপুল এলাকায় পচা গরুর মাংস বিক্রির অভিযোগে এক ব্যবসায়ীকে জরিমানা করা হয়।
এক মাংস বিক্রেতা আক্ষেপ করেন, একসময় দেখেছি নদীর ধারে মরা গরু পড়ে থাকত। শকুন বা অন্য প্রাণী খেত। কিন্তু এখন আর দেখা যায় না। মনে হচ্ছে, এখন আর গরু মরে না! আর যদি মরে তাহলে যায় কোথায়?যশোর পৌরসভা সূত্রে জানা যায়, শহরের ৯টি ওয়ার্ডে কমপক্ষে ৮০টি মাংসের দোকান রয়েছে। এর মধ্যে গরুর মাংসের দোকান প্রায় ৫০টি। খাসির মাংস বিক্রির দোকান রয়েছে শহরের বস্তাপট্টিতে ১০টি, বড়বাজারে ২টি, পালবাড়ি ও চুয়াডাঙ্গা বাসস্ট্যান্ডে ১টি করে। এর বাইরে পৌর এলাকার মধ্যে কিছু ভ্রাম্যমাণ মাংসের দোকানও রয়েছে। যেখান থেকে পৌরসভা নিয়মিত কর আদায় করে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, গরুর মাংস বিক্রেতাদের প্রতিদিন ৫০ টাকা করে কর দিতে হয়। ছাগল বা খাসির জন্য দিতে হয় ৩০ টাকা। পৌরসভার রসিদেই এই কর আদায় করেন ‘কসাইখানা পরিদর্শক’। মাংস বিক্রেতাদের অভিযোগ, কসাইখানার কোনো সুবিধা না থাকলেও নিয়মিত টাকা দিতে হয়। এই সুযোগে কিছু অসাধু ব্যবসায়ী অসুস্থ গরুর মাংস বিক্রি করছে। অনেক সময় তারা মরা গরুর মাংসও বিক্রি করেন।
মুরাদ হোসেন নামে এক বিক্রেতা বলেন, নির্দিষ্ট কোনো স্থান না থাকায় যত্রতত্র পশু জবাই হচ্ছে। ফলে পশুর স্বাস্থ্যগত মান পরীক্ষা হয় না। শওকত আলী বাবু বলেন, পৌর প্রশাসনের সদিচ্ছা ও কতিপয় অসাধু ব্যবসায়ীর কারণে কসাইখানা গড়ে ওঠেনি। কয়েকদফা চেষ্টা করেছি, কোনো লাভ হয়নি। মাংস বিক্রেতারা বলছেন, প্রতিদিন পৌর এলাকায় ৭০ থেকে ৮০টি গরুর মাংস বিক্রি হয়। তবে, শুক্রবারে এই সংখ্যা হয় দ্বিগুণ। কসাইখানা থাকলে সঠিক হিসাব পাওয়া যেত।
পুরাতন কসবার মাংস ক্রেতা আনিস রহমান বলেন, বিশ্বাসের ওপর ভর করেই আমরা মাংস কিনি। অন্ধের মতো আমরা মাংস কিনে খাচ্ছি। মাংসের নামে কী খাচ্ছি, অজানা। সুস্থ গরুর মাংস খাচ্ছি কি না বলতে পারব না।আরেক ক্রেতা জসিম উদ্দীন বলেন, এঁড়ে গরুর মাংসের নামে প্রায়ই আমাদের বকনা গরুর মাংস দিয়ে দেয় বিক্রেতারা। বোঝার কোনো উপায় নেই।
এ বিষয়ে পৌর নাগরিক কমিটির সদস্য সচিব জিল্লুর রহমান ভিটু বলেন, ভোক্তারা সবখানেই জিম্মি। বাজার ব্যবস্থাপনা নেই। সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্য, অস্বাস্থ্যকর খাদ্য, ইচ্ছামতো পণ্যের দাম-সবই চলছে। ত্রিশ বছরের বেশি সময় ধরে একটা কসাইখানা করতে পারেনি পৌর কর্তৃপক্ষ।
জেলা প্রাণিসম্পদ অফিসার ডা. মো. সিদ্দিকুর রহমান বলেন, শহর অঞ্চলে স্বাস্থ্যসম্মত উপায়ে পশু জবাই এবং নিরাপদ মাংস সরবরাহ নিশ্চিত করতে চার বছর আগে আধুনিক স্লটার হাউজ নির্মাণে মন্ত্রণালয় থেকে বরাদ্দ আসে। কিন্তু পৌরসভা জায়গা দিতে না পারায় সেই বরাদ্দ চলে যায় নড়াইলে।
অস্বাস্থ্যকর মাংস খাওয়ার ফলে পুষ্টির বিপরীতে চরম স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি হচ্ছে বলে জানিয়েছেন যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের পুষ্টি ও খাদ্য প্রযুক্তি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক তানভীর আহমেদ। তিনি বলেন, আমাদের অসচেতনতার কারণে এই মাংস হতে পারে অনেক জটিল এবং কঠিন রোগের কারণ। যদি সঠিকভাবে প্রক্রিয়াজাতকরণ,পরিবহণ, সংরক্ষণ এবং রান্না না করা হয় তাহলে বিভিন্ন ধরনের ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া এবং প্যারাসাইট দ্বারা মাংস সংক্রমিত হতে পারে। এসব দূষিত মাংস খাওয়ার কারণে মানুষের অনেক ধরনের খাদ্যবাহিত রোগ এমনকি মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে। ১৪.৭২ বর্গ কিলোমিটার আয়তনের যশোর পৌরসভার মোট জনসংখ্যা ২ লাখ ৯ হাজার ৩৫২ জন (জনশুমারি ও গৃহগণনা ২০২২-এর তথ্যানুযায়ী)। বর্তমানে ভারপ্রাপ্ত স্যানিটারি ইন্সপেক্টর হিসাবে রয়েছেন মো. আসাদুজ্জামান। ২০২২ সালে তিনি যোগদান করেন ভ্যাকসিনেটর সুপারভাইজার হিসাবে। তিনি জানান, নামে স্যানিটারি ইন্সপেক্টর হলেও তার কোনো ক্ষমতা নেই। দীর্ঘদিন লোক না থাকায় তৎকালীন মেয়র হায়দার গণী খান পলাশ তাকে দায়িত্ব দেন। তবে ত্রিশ বছর আগে লুৎফর রহমান পাটোয়ারী নামে একজন স্যানিটারি ইন্সপেক্টর পৌরসভাতে ছিলেন। কসাইখানা পরিদর্শকের একটি পদ রয়েছে পৌরসভায়। সেই দায়িত্বে থাকা আবু তারেক বলেন, একবেলা মাংস বিক্রেতাদের থেকে কর আদায় আর অন্যসময় টিকা কর্মসূচির কাজ করি।
এদিকে কত সালে যশোরে কসাইখানা বন্ধ হয়েছে তার সুনির্দিষ্ট তথ্য নেই পৌরসভার কাছে। প্রশাসনিক কর্মকর্তা উত্তম কুন্ডু জানান, নথি ইঁদুরে খেয়ে গেছে। পুরোনো কোনো নথি পৌরসভায় সংরক্ষিত নেই। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সবশেষ স্লটার হাউজ ছিল শহরের জেল রোডে। কিন্তু ১৯৯৯ সালে সেখানে নির্মিত হয় জেল রোড জামে মসজিদ। স্থানীয় বাসিন্দা ও মাংস বিক্রেতারা জানায়, মসজিদ নির্মাণের চার-পাঁচ বছর আগেই বন্ধ হয়ে যায় পৌর এলাকার একমাত্র কসাইখানা। তবে আশার বাণী শুনিয়েছেন পৌর প্রশাসক রফিকুল হাসান। তিনি বলেন, শহরের কাঠেরপুলে স্বল্প পরিসরে একটি স্লটার হাউজ নির্মাণের পরিকল্পনা করা হয়েছে। দ্রুতই কাজ শুরু হবে।
