উত্তরা সাবরেজিস্ট্রি অফিসে জালজালিয়াতি করে বড় অঙ্কের রাজস্ব ফাঁকি দেওয়ার ঘটনায় অবশেষে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। ঢাকা জেলা রেজিস্ট্রারের দপ্তর থেকে মঙ্গলবার এ তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়।
এদিকে তদন্ত শুরু হওয়ায় জড়িত ঘুস সিন্ডিকেটের সদস্যরা চাকরি রক্ষায় নানামুখী তদবিরে দৌড়ঝাঁপ শুরু করেছেন। এছাড়া দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) তদন্তের ভয়ে নামে-বেনামে গড়ে তোলা অবৈধ অর্থসম্পদের তথ্য গোপন করতে ফাঁকফোকর তালাশে ব্যস্ত। তবে চিহ্নিত এ চক্রের কোনো সদস্যকে এখনো দায়িত্ব থেকে অপসারণ করা হয়নি।
প্রসঙ্গত, ‘শুঁটকির বাজারে বিড়াল চৌকিদার : রাজস্বের বড় অংশ ঢুকছে ঘুস সিন্ডিকেটের পকেটে’ শিরোনামে ১৯ অক্টোবর প্রথম সারির গণমাধ্যমে অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। এরপর নড়েচড়ে বসে জেলা রেজিস্ট্রারসহ ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ। কিন্তু জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার পরিবর্তে একশ্রেণির কর্মকর্তা উলটো তাদের রক্ষা করতে মাঠে নামেন। এমনকি রহস্যজনক কারণে ঢাকা জেলা রেজিস্ট্রার মুনশী মোকলেছুর রহমানও কোনো ব্যবস্থা না নিয়ে বিষয়টি এড়িয়ে যান। তবে ‘ঘুস সিন্ডিকেটের সদস্যরা বহাল’ শিরোনামে রোববার যুগান্তরেও একটি রিপোর্ট প্রকাশিত হলে অনেকটা বাধ্য হয়ে এ তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। এক সদস্যের তদন্ত কমিটির প্রধান করা হয়েছে বাড্ডা সাবরেজিস্ট্রার মো. জাহাঙ্গীর আলমকে। ১৫ কার্যদিবসের মধ্যে রিপোর্ট দিতে বলা হয়েছে।তবে যুগান্তরে প্রকাশিত অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে অভিযোগের মূল বিষয় ছিল-উত্তরা সাবরেজিস্ট্রি অফিসে বেপরোয়াভাবে ঘুস-দুর্নীতি শুরু হয় মূলত সাবেক সাবরেজিস্ট্রার লুৎফর রহমান মোল্লার সময় থেকে। এরপর থেকে বেশির ভাগ দলিলে সরকারের ভ্যাট ও উৎসে কর (১২৫ ও ১২৬ ধারা) ঢুকছে ঘুসচক্রের পকেটে। মিথ্যা তথ্য আর জালজালিয়াতির আশ্রয় নিয়ে শক্তিশালী সিন্ডিকেট দীর্ঘদিন থেকে বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। মাত্র ৮টি দলিল বিশ্লেষণ করে যুগান্তরের অনুসন্ধানে কোটি কোটি টাকার রাজস্ব ফাঁকির ঘটনা ধরা পড়েছে।
প্রকৃত রাজস্ব ফাঁকি দিতে বায়না দলিল গোপন রেখে সাফ কবলা দলিলে সম্পত্তিমূল্য অনেক কম দেখিয়ে রেজিস্ট্রি সম্পন্ন করে। এর ফলে এক দলিলেই সরকার সোয়া তিন কোটি টাকা কম রাজস্ব পেয়েছে। এর বিনিময়ে চক্রটি দুই দফায় ঘুস নিয়েছে কোটি টাকা। অপরদিকে একটি দলিলের পাতা পরিবর্তন করে মোটা অঙ্কের উৎসে কর ফাঁকি দেওয়া হয়েছে। এছাড়া একই ভবনে থাকা ১টি ফ্ল্যাট রেজিস্ট্রির সময় উৎসে কর ও ভ্যাট নেওয়া হলেও বাকি ৪টি দলিলে নেওয়া হয়নি। গত তিন বছরের দলিল যাচাই-বাছাই করা হলে বিপুল অঙ্কের রাজস্ব ফাঁকি ধরা পড়তে পারে।
সূত্র জানায়, নিবন্ধন ম্যানুয়াল-২০১৪-এর ৬৩ক(২) মোতাবেক সংশ্লিষ্ট নিবন্ধন কর্মকর্তা বা সাবরেজিস্ট্রার তথ্য গোপন করে রাজস্ব ফাঁকি দিলে তার দায় এড়াতে পারবেন না। এ ধারার উপবিধি-২-এ স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে, ‘যেক্ষেত্রে অনুসন্ধানক্রমে বা অন্য কোনোভাবে জানা যায় যে, উপধারা (১)-এর বিধান অমান্য করিয়া অনুপযুক্ত মাশুল ও ফি গ্রহণপূর্বক নিবন্ধনকারী কর্মকর্তা কর্তৃক কোনো দলিল নিবন্ধন করা হয়েছে, সেই ক্ষেত্রে নিবন্ধনকারী কর্মকর্তার এইরূপ আইন অমান্যকরণ অসদাচরণরূপে গণ্য হইবে এবং উক্ত অপরিশোধিত মাশুল ও ফির অর্থ সংশ্লিষ্ট নিবন্ধনকারী কর্মকর্তার নিকট হইতে আদায় করা হইবে।’এদিকে তদন্তে এভাবে রাজস্ব ফাঁকি তথা অসদাচরণের অপরাধ প্রমাণিত হলে সাবরেজিস্ট্রারসহ সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে সরকারি কর্মচারী (শৃঙ্খলা ও আপিল) বিধিমালা ১৯৮৫ ও কর্মচারী আইন ২০১৮ অনুযায়ী জড়িতদের শাস্তির মুখোমুখি হতে হবে। বিভাগীয় মামলা দায়েরসহ তদন্ত প্রতিবেদনে দোষী সাব্যস্ত হওয়া সাপেক্ষে অসদারণের শাস্তি হিসাবে গুরুদণ্ডে দণ্ডিত হবেন। এছাড়া অর্থ আত্মসাৎ সংঘটিত হওয়ায় একই অপরাধে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) আইনেও অনুসন্ধান শেষে মামলা দায়ের হবে।
এদিকে বায়না দলিলের তথ্য গোপনসহ এ ধরনের পরিকল্পিত রাজস্ব ফাঁকির ঘটনায় জড়িতরা হলেন উত্তরা সাবরেজিস্ট্রি অফিসের একজন প্রভাবশালী নকলনবিশ এবং তার আত্মীয় দলিল লেখক মো. উত্তম। এছাড়া আছেন সাবেক সাবরেজিস্ট্রার লুৎফর রহমান মোল্লার ক্যাশিয়ার খ্যাত ঝাড়ুদার মঞ্জু, নকলনবিশ মারুফ আহমেদ সাগর, নকলনবিশ সমিতির সভাপতি ফিরোজ, মো. শহীদ, শাজাহান, নকলনবিশ সুমন ও কনক। এ চক্রের সঙ্গে আরও বেশ কয়েকজন প্রভাবশালী জড়িত। যথাযথভাবে তদন্ত হলে প্রত্যেকের দায়দায়িত্ব চিহ্নিত করা সম্ভব হবে
এদিকে উত্তরা অফিসের নির্ভরযোগ্য একটি সূত্র জানায়, জড়িতরা অফিসের মধ্যে বলছেন তদন্ত হলে কাগজে-কলমে তাদের সম্পৃক্ততা কেউ প্রমাণ করতে পারবে না। হয়তো দু-একজন ফেঁসে যাবে। তবে আইন অনুযায়ী সাবেক সাবরেজিস্ট্রার লুৎফর রহমান মোল্লা, বর্তমান সাবরেজিস্ট্রার তৌহিদুল ইসলাম এবং সংশ্লিষ্ট দলিল লেখকরা কোনোভাবে দায় এড়াতে পারবেন না। কিন্তু দুদকের অনুসন্ধান নিয়ে তারা বেশি চিন্তিত। তাদের ভয়, যদি দুদক তদন্ত শুরু করে তাহলে সবাই ধরা পড়ে যাবে। কারণ, তাদের নামে-বেনামে থাকা বাড়ি, ফ্ল্যাটসহ কোটি কোটি টাকা সম্পদের পেছনে বৈধ আয়ের কোনো উৎস তারা দেখাতে পারবেন না।
কমিটি গঠনের পর তদন্ত শুরু হয়েছে কি না জানতে চাইলে বাড্ডা সাবরেজিস্ট্রার জাহাঙ্গীর আলম গণমাধ্যম কর্মীদের’ কে বলেন, ‘আমার অফিসে কাজের চাপ অনেক বেশি। তা সত্ত্বেও যেহেতু দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে, দ্রুত তদন্তকাজ শুরু করব।’
